পৃথিবীর বয়স

শুক্রবার দিনটা আমার খুব পছন্দের। সারাদিন আরাম করে ঘুমানো যায়। আমি দুই-তিনটা মুভি দেইখা ফেলি একদিনেই।

বোরিং লাগলে মাঝে মধ্যে নিচে গিয়া মাসুদরে একটু গুতা দিয়ে আসি। সে শ্রমিক দিবসের মানে বলতে না পারায় তার বেতন কাটছিলাম। ভালো লাগছিলো!

আজকে সকাল সকাল নিচে নামলাম। রাতে ইন্টারস্টেলার দেখসি। মাথা জ্ঞানের ভারে ব্যাথা করতেসে। কবি বলেছেন আনন্দ নিজের, কিন্তু ব্যাথা সবার সাথে ভাগ করে নিতে হয়। আমি তাই মাসুদরে খুঁজতেসি ব্যাথা ভাগ করে নেয়ার জন্য।

দেখি সে চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছে। গিয়া দিলাম চেয়ার বরাবর একটা লাথি।

মাসুদ নিচে পড়ে গিয়ে পিটপিট করে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার মুখে ভিলেনের হাসি দেখে তার মুখ শুকিয়ে গেছে।

– তোর জন্য একটা প্রশ্ন আছে। উত্তর দিতে পারলে আজকে দুপুরে কাচ্চি খাওয়াবো। আর না পারলে দুপুরে তোর খাবার বন্ধ।

কাচ্চির লোভে মাসুদ নাক দিয়ে একটা ঘোঁত শব্দ করল শুয়োরের মত।

– বলতো, পৃথিবীর বয়স কত?
– এইটা তো সোজা, এখন ২০২৪ সাল চলতেসে বস। তারমানে পৃথিবীর বয়স ২০২৪ বছর। মাসুদ অতি বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ল।

আমার মুখে ভিলেনের হাসি। জানতাম সে পারবে না। সে কোনদিন বিসিএস এ পাশ করতে পারবে না।

– তুমি কোনদিন জ্ঞানী হতে পারবা না মাসুদ। যাও ওই কোনায় গিয়া কান ধরে দাঁড়ায় থাকো। গেইট দিয়েই যেই আসবে তাকে মিলিটারি স্টাইলে স্যালুট দিবা। এটাই তোমার শাস্তি।

– বস আমারতো মিলিটারি বুট নাই। মাসুদ করুন মুখে বলে।
– বুট লাগবো না হারামজাদা। তুই গিয়া দুপুর পর্যন্ত দাঁড়ায় থাক। নাইলে মিলিটারি স্টাইলে তোকে ডিম থেরাপি দিবো।

আমি গেইট দিয়ে বের হয়ে আসলাম। যাই গনিরে গিয়া জিগ্যেস করে আসি, দেখি সে বিসিএস এর যোগ্য কিনা। যদিও মনে হয় গনি পারবে না। রঙ চায়ে চিনি দিয়া জিহবায় কামড় দেয়া বাদে তার বিশেষ কোন প্রতিভা নেই। যদিও সে ভাব ধরে সে রাজনীতির ব্যপারে বিশাল পন্ডিত।

গনির দোকানে আজকে কোন ভিড় নাই। শুক্রবার সকালে কি মানুষজন চা খায় না? এই জাতির কি হবে? বৃহস্পতিবার রাতে সব নেশা করে এখন ঘুমাচ্ছে।

– গনি ভাই একটা রঙ চা দাও, চিনি দিবা না।
গনি কোন কথা না বলে চা বানান শুরু করল। চোখের নিচে ফোলা, কালসিটে পড়ে আছে। নিশ্চিত রাইতে মাল খাইতে গিয়া বউয়ের হাতে মাইর খাইসে।

– কে মারসে, বউ?

গনি কথা বলে না। চায়ে চুমুক দিয়া দেখি এইটা রসগোল্লার মত মিষ্টি। শালার চুষ্টি গুদি…।

– গনি ভাই, পৃথিবীর বয়স কত জানো?
– ঐটা জাইনা কি হইব? গরীব মানুষের পুটকি মারা বন্ধ করব সরকার?
– কখন মারল?
– মজা কইরেন না ভাই। মন ‘মিজাজ’ বেজায় খারাপ। সরকার যেমনে জিনিসপত্রের দাম বাড়াই দিতেসে… বউ বাচ্চা নিয়া শহরে আর থাকা যাইব না।

আমি জানতাম গনিও পৃথিবীর বয়স বলতে পারবে না। দেশটা অশিক্ষিতে ভরে গেছে, জ্ঞানী লোকেরা এই জন্যই দেশে থাকে না। টাকা পাচার করে বাইরে চলে যায়। লাস ভেগাস আর দুবাই তাদের প্রিয় জায়গা।

– কই যাবা?
– চিন্তা করতেসি গ্রামে চইলা যাবো।
– ঐখানে কি অন্য সরকার চলে? ওইখানে গেলে কি সরকার তোমার পুটু মারবে না?

গনি বিরক্ত মুখে তাঁকাল। তবে মুখে চিন্তার ছাপ। সরকার যে একটাই এইটা সে মনে হয় চিন্তা করে নাই। গ্রামে গিয়েও যে তাকে পুটু মারা খেতে হতে পারে এই ব্যাপার সে আগে চিন্তা করে নাই।

– তুমি বরং, চায়ের বদলে শরবত বেচা শুরু করো, মোহাব্বতের শরবত। দোকানের নাম দিবা, “গনি’স পেয়ার” মানে গনির ভালোবাসা।
– তাইলে চলব?
– আলবৎ চলবে। বাঙ্গালী এখন শরবতের দোকানে লাইন দেয়। আগে টাকা পরে ওয়ানটাইমে তোমার চা দিয়া দিবা। স্পেশাল মহব্বত।
– চা?

-“হ” – তোমার চা আর শরবতে কোন তফাৎ নাই। চা বইলা বেচো দেইখাই লোকজন আসে না।
– ভাইজান কি আমারে ইনসাল্ট করলেন? আমি চৌদ্দ বছর ধইরা চা বানাই।
– চৌদ্দ কেন চল্লিশ বছর ধরে বানাইলেও তুমি শরবতই বানাবা। জ্ঞানী লোকেরা চায়ে চিনি খায়না তুমি জানো না?

গনি জিহ্বায় কামড় দিল। “দেন আরেক কাপ বানায় দেই।”

– নাহ… আর খাবো না। যেই চা বিক্রেতা পৃথিবীর বয়স জানে না, তার ব্যবসার উন্নতি হবে কেমনে?
– জানি ভাইজান, পৃথিবীর বয়স ৪৫ বছর।
– কেমনে জানলা?
– আমার জন্মের পর থেকে পৃথিবী দেখতাসি, তাই আমার বয়সের সমানই পৃথিবীর বয়স।

আমি গনির এহেন দার্শনিক কথায় চমৎকৃত হলাম। মাঝে মাঝে সে অসোর (Osho) মত বালছাল যুক্তি দেয়। শুনলে মনে হয় সে মহাজ্ঞানী।

আমি গনির দিকে তাঁকিয়ে চোখ টিপে দিলাম।

– চালায় যাও গনি ভাই, তুমি মুরিদ পাবা। এখন আরেকটা প্রশ্নের জবাব দাও ভাইবা চিন্তা। মানুষের দেহে ফুটা কয়টা?

আমি চায়ের দাম না দিয়েই চিন্তিত গনিকে রেখে হাঁটা দিলাম। সে ফুটা গুনুক।

দিনটা সুন্দর। এইরকম দিন দেখেই কবি বলেছিলেন, মরিতে চাহিনা আমি এই বেয়াক্কেলদের ভুবনে।

– কাপু একজন জ্ঞানী পরিব্রাজক

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন