পোস্টগুলি

মিনা বাজার

আজিমপুর মিনা বাজার আউটলেটে গেলাম সেদিন। উবার আসতে দেরি করতেসে তাই হুদাই এটা ওটা নাড়তেসি। ঢাকা ভার্সিটির দিকে নাকি পোলাপান সব গেইট আটকাইয়া নিজেদের ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ঘোষনা করেছে। তাই এলাকা জুড়ে বিশাল জ্যাম। উবার চালক খালি বলে আসতেসি, কিন্তু আসার নামগন্ধ নাই।

শেলফে দেখলাম মোয়া, নাড়ু এইগুলা রাখা আছে। কিন্তু প্রচুর চাইনিজ তেলাপোকা ঘুরঘুর করতেসে সেগুলার উপর। একটা চিড়ার প্যাকেটের ভিতরেও দেখলাম কয়েকটা আছে।

একজনরে ডাক দিয়ে দেখাইলাম, বেডি কিছু না বলে চিড়ার প্যাকেট নিয়ে চলে গেল। আমি আর মোয়া কিনলাম না। কয়েকটা ড্রিঙ্কস নিয়ে কাউন্টারে চলে গেলাম। টিন ফুটা কইরা অন্তত চাইনিজ তেলাচুরা ঢুকতে পারবে না।

- ভাই আপনাদের খাবারের শেলফে প্রচুর তেলাপোকা। এইগুলা তো ফালাই দেয়া দরকার।

কাউন্টারের ছেলেটা ব্যাপক ব্যস্ত। শুধু বলল- "তেলাপোকার ঔষধ দিতে হবে।"

- তেলাপোকার ঔষধ পাশের শেলফেই আছে। আমি দিয়ে দেই?

পোলায় কোন কথা বলে না। একটা হিমু হিমু ভাব আছে এর মধ্যে। জগতে দুই-চাইরটা তেলাপোকা থাকলেই কি আর না থাকলেই কি?

- তেলাপোকা তো কামড় দেয় না।

এই মহাজ্ঞান লাভ করে আমি মিনা বাজার থেকে বের হয়ে আসলাম। অর্বাচীনের সাথে তর্ক করে কি লাভ? এই দেশের মানুষ যেরকম সুপারশপও সেরকম হবে। এইখানে তেলাপোকা আর ইঁদুর থাকাটা খুব স্বাভাবিক!

একজন ম্যাজিট্রেটকে ফেইসবুকে মাঝেমধ্যেই দেখি ব্যপক ভাবের সহিত সব জায়গায় গিয়ে তদারকি করেন। কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে দেশে কোন ট্রেইনিং দেয়া হয় কিনা জানি না। দোকান খোলার আগে সার্টিফিকেশন লাগে কিনা জানি না।

এরা যদি মদ বেচত তাইলে অবশ্য আমি মাইন্ড করতাম না। মদে কোন ভেজাল নাই। পুরান মদ টেস্টি হয়।

মিনা কার্টুন দেখতাম ছোটবেলায়। সে দৈত্যের কাছে স্বপ্নে ল্যাট্রিন চায়, কেন চায় আজও আমি বুঝি নাই। আমরা ল্যাট্রিন বিপ্লবে সফল হয়েছি। ইন্ডিয়ানরা নাকি এখনও খোলা আকাশের নিচে হাগে। প্রাকৃতিক কাজ প্রকৃতির সান্নিধ্যেই উত্তম।

আমরা উত্তম জাতি। আমরা বিপ্লবী।

উবার আসছে। সে খিস্তি করতেসে। রাস্তায় জ্যাম নাকি ইচ্ছা কইরা লাগাইসে। আমি জিগাইলাম- "লাল স্বাধীনতা কেমন লাগছে।"

- ভাই, মজা কইরেন না। পছন্দ না হইলে নামায় দিবো কিন্তু।

- উত্তম...। আমি চুপ করে গেলাম। তার অবশ্যই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে আমাকে নামিয়ে দেয়ার। গন্তব্যে গিয়ে তাকে একটা পাঁচ তারা দিয়ে দেবো।

 


 



বাতির নিচে অন্ধকার থাকে, পানির নিচে কুমির

মন মেজাজ অত্যধিক খারাপ থাকায় কয়দিন বাসা থেকে বের হই নাই। ভোমা আর সদানন্দের পারিবারিক ঝামেলাতেও নাক গলাই নাই। মেয়েলোক ঘটিত ঝামেলায় নাক না গলানোর শিক্ষা আমি ইতিহাস থেকে আমি নিয়েছি। এই কারনে ট্রয় নগরী পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যদিও অনেক ইতিহাসবেত্তা বলবেন পুরো ব্যপারটাই পরকীয়ার কারনে ঘটেছে। কিন্তু চিন্তা করে দেখেন, মেয়ে মানুষ না থাকলে পরকীয়া কিভাবে হবে?

যাক সে কথা, সেদিন সন্ধ্যায় সদানন্দ ফোন দিয়া বলে ভোমা আর সে আসতেসে দেখা করতে। বুঝলাম মিটমাট হয়ে গেছে। গেলাম চিল করতে। সদায় মাল খায় না। তাই স্টার কাবাব থেকে একপিস গরুর শিক কিনে দিল। আমি আর ভোমা কিঞ্চিত জলপান করলাম। সেখানেও সদার কাছ থেকে কিছু খসানো গেলো। যদিও বারে আমরা জলপান করার জন্য যাই না। বারের খাবার আর সালাদ খুবই উচ্চমার্গীয় হয়। সেইটার লোভেই বারে যাওয়া।

সদানন্দরে জিজ্ঞেস করলাম, টেকাটুকা কই পাস? বউয়ের কাছ থেকে নিছস?

- বউ দিবো কেন? এইটা ব্যাংক থেকে লোন নিসি। সেইটাই খরচ করতেসি। মাসে মাসে কিস্তি দেই ব্যবসার থেকে। শেষ হইলে আবার লোন নিমু।

- অসাম... আমি মনে মনে বললাম।

ভোমায় বলল, প্যাড়া নাই বন্ধু চিল। টেকা আছেই খরচ করবার জন্য। ব্যাংকের হোক আর নিজের হোক, টেকার ধর্মই খরচ হওয়া।

আমি এই ব্যাপারে আর কথা বাড়াই না। বারে অনেক দাড়িওয়ালা মুরুব্বী দেখা যাচ্ছে। দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। কে কার থেকে বড় ইতর এইটা প্রমানের আপ্রান চেষ্টা চলছে। আর বাদ বাকি দর্শক যারা আছে, তারা সবাই এখানে সালাদ খাইতে আসে আমাদের মতো।


ঝগড়া

সদানন্দ আর ভোমায় ঝগড়া লাগসে। প্রথমদিন সদানন্দ ফোন দিয়া কি যে কইল সেইটা আমার মাথার উপর দিয়া গেল। তবে এটা শিওর - ভোমায় অরে খান... মাগি কইয়া গাইল দিসে। তার বউরে নিয়াও নাকি মেলা আকাশ-পাতাল বক্তব্য দিয়েছে।

আমি শুধু শুনলাম আর হুঁ হুঁ করলাম। 

কোন মন্তব্য করতে পারি নাই দেইখা সদানন্দ কিছুটা ক্ষেপল আমার উপর। দুইবার ফোন দিয়াও তারে পাই নাই পরেরদিন।

এরপর ভোমায় আবার ফোন দিয়া একইরকম স্ক্রিনশট পাঠায়া কয়, সদানন্দ হালায় একটা মাতাল, উজবুক।

আমি শুধু শুনলাম আর হুঁ হুঁ করলাম। 

অন্যসময় কেউ ঝগড়া লাগলে মনে বেজায় আনন্দ হয়। আজকে কিছুই ফিল হইল না। নিরব থাকলাম। তারমানে আমি কবি হতে পেরেছি।

কারন, "কবি এইখানেই নিরব।"

নিরবতা আবার সম্মতির লক্ষন। সেই হিসেবে সদানন্দ আর ভোমা দুইটাই বলদ কিসিমের। সেইটাতে আমি সম্মতি দিসি। মারামারি লাগসে তাদের বউগো কথাবার্তা নিয়া। মাইয়ালোকের ক্যাচাল বিয়ার পরেও গেলনা। এই জন্যেই কবি বলেছেন পুরুষের সবথেকে বড় শত্রু তার নুনু।

বিয়া জিনিসটার ম্যালা ক্যাচাল আছে। না করলেও সমাজ বলবে তুমি খারাপ পাড়ায় যাও, আর করলে বলবে বউয়ের কথায় চলো।

সমাজের চুষ্টি গুদি তাই।

দুইদিন পরে, ভোমার ম্যারেজ এনেভার্সারিতে সদারে ফোন দিয়া সে সরি বলছে। ডিনারের দাওয়াত দিসে। আমি যামু কিনা চিন্তা করতেসি। দাওয়াতের ছদ্মবেশে এটা একটা ট্র্যাপ হইতে পারে। দেশে এই রকম মেটিকুল্যাস ডিজাইনের অনেক কিছু ঘটে গেছে। "সুই হইয়া ঢুইকা ফাল হইয়া বের হবার" ইতিহাস এই জনপদে অসংখ্য। আগে এদের নাম মিরজাফর আছিল। এখন অর্গানাইজার নাম নিসে।

আমি হালকার উপর চিপায় ঢুকে যেতে চাচ্ছি। দুই পক্ষের মারামারির মধ্যে থাকলে সমস্যা।

 


রাস্তা

পাশের বিল্ডিঙের  গ্যারেজে বাইক রাখি। নিজেরটা ভাড়া দেয়া। এইটারে বলে বিজনেস। গ্যারেজে বাইক রাখতে গিয়া দারোয়ান সাম এর সাথে দেখা। এইটারে দেখলেই আমি দ্রুত এলাকা থেকে ভাগতে চাই। শালা সারাদিন বিড়ি খায় আর আমারে দেখলেই চা-নাস্তার জন্য পঞ্চাশ-একশ টাকা দাবি করে। 

এই বিল্ডিঙে দুইজন দারোয়ান আছে - একজন সাম আরেকজন দিলীপ। দিলীপ কিছুটা ভালো আর ভদ্রলোক। তার কোন দাবি-দাওয়া নাই। সারাদিন টুলে বসে ঝিমানোই তার কাজ।

তবে সাম কিছুটা বদ প্রকৃতির। সে বিড়ি খায় এবং সকাল বেলা ঘুমায়। আমি বাইক ওয়াশ করে আনলেও, সে বলবে, "বস, মুইছা পরিষ্কার করে রাখসি। চা-নাস্তা খাওয়ার টাকা দিবেন।"

ধোয়া শার্ট আবার ধুইয়া, কেউ পয়সা চাইলে কেমন লাগে? এরে মাসুদরে দিয়ে কেলানি দিলে ভালো লাগত!

কাঁটাবনে যাচ্ছিলাম। রিকশয়ায় এক নব্য দম্পতি। অটোরিকশা গাড়ির লেইন দিয়া সুপার স্পিডে যাচ্ছে। তারে বেশ কয়েকবার হর্ন দিলাম সাইড দেয় না। আমি সামনে গিয়ে পাশ থেকে সুপার স্পিডে তারে একটু ভড়কে দিলাম।

পিছন থেকে আমারে "বানচোত... বলে গালি দিলো মনে হল। হেলমেট থাকায় ঠিক শুনতে পেলাম না।" আবার একটু বাইক স্লো করে অপেক্ষা করলাম। এবার সে গাড়ির লেইন ছেড়ে এসেছে। আমারে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে আমি মধুর স্বরে জিগ্যেস করলাম, "হুজুর কি গালি দিয়েছেন?"

- তো এমনে বাইক চালায়?

আমি ঠিক নিশ্চিত না গালিটা কে দিয়েছে। অটোর সিটে বসা বেয়াক্কেলটাও দিতে পারে। আপু নিশ্চিত বাইঞ্চোত মার্কা গালি দিবে না। হাজার হোক তার নিজের বোন থাকতে পারে। আমি কোনভাবেই তার দুলাভাইয়ের মত দেখতে না। আপুর পাশে বসা ভাইয়াও দিতে পারে, আবার সফেদ দাড়িওয়ালা অটোচালকও হতে পারে। যারা অটো রিকশায় ওঠে তারা আসলে নিজের জীবনকে ভালোবাসে না। এরা অন্যকে কি ভালোবাসবে? এদের প্রেমে ভেজাল আছে।

তাইতো মহাকবি খাড়াটান বলেছেন, "যে নিজেকে ভালোবাসে না, সে অটো রিকশায় চড়ে।"

কিছু জ্ঞান দেবো ভাবছিলাম। কিন্তু অটো চালক থামতে নারাজ। সে আমাকে নরকের অভিশাপ দিতে দিতে চলে গেলো। এই সপ্তাহে কিছু পূন্য কামাইসিলাম, সেটা কাটাকাটি হয়ে গেলো। যাক... বাংলাদেশ বেশি পুণ্যবান মানুষের থাকার জায়গা না। এইটা ভদ্রলোকদের জন্য জাহান্নাম।

দেশ স্বাধীন হইলে কি হয় আমি জানি না, এখনও কোন পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না। তবে এই অটো-চালকরা স্বাধীনতা উপভোগ করছে। রাস্তায় মানুষের থেকে এদের সংখ্যা বেশি।

রাস্তার পাশে বাইক ধোয়ার জন্য মেলা দোকান আছে কাঁটাবনে। আমার পরিচিত একটা দোকানও আছে। সেখানে বাইক থামিয়ে বললাম, ওয়াশ করো।

- ভাই, বাইক তো পরিষ্কারই আছে।
- তাও করো।
- ওকে বস। সে বেজার মুখে পানির হোস আর সাবান আনতে গেলো। তার মুখ বেজার কারন মোবাইলে পাবজি খেলতেসিল। খেলায় ডিস্টার্ব হইসে।

পোলাপান প্রচন্ড বেয়াদব। এদের উন্নতি হবে না। ঠিক মত কাজ করলে আজকে বাইক ধুচ্ছিস, কালকে এরোপ্লেন ধুবি। ভাগ্যের কথা কে বলতে পারে? অভিজ্ঞতা এখন কোন বিষয় না। ভাগ্যে থাকলে তুই দেশের রাজাও হয়ে যেতে পারিস।

ছেলেটা বদ আছে। যখনই রাস্তার পাশ দিয়ে, মানুষ বা রিকশা যাচ্ছে সে পানি দিয়ে তাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমি তারে মানা করলাম সে শুনলো না। এরপর মোবাইলে তার ভিডিও করে রাখলাম। একে ভাইরাল করে দিতে হবে।

আজকাল যে ভাইরাল হবে সেই মারা খাবে। জাস্টিস বলে কিছুতো থাকতে হবে! দেশে আইন নাই, কিন্তু ফেইসবুক তো আছে!

তবে আমি ঠিক করেছি আজকে থেকে আবার ভদ্রলোক হয়ে যাবো। রাস্তঘাটে রিকশা আর অটোওয়ালাদের খিস্তি দেব না। হাজার হোক এই শহরটা তাদের। আর গরীবের কোন পাপ হয় না।

রুমি বলেছিল, সবার সাথে যুদ্ধ করার থেকে, নিজের ইগোকে মেরে ফেলো। আমি সেই ইগোকে খুঁজছি। পাইলেই খতম!


- - জনৈক বাইকার


গণির পরোটার দোকান

নিচে নেমে দেখি মাসুদ একমনে মোবাইলে কি জানি দেখতেসে। আমি যে পেছনে চলে এসেছি সেটা সে খেয়ালই করে নাই। পেছনে গিয়া বললাম, "হালুম"।

হাতের মোবাইল পড়ে গেল তার ভয় পেয়ে।

- কি করো তুমি? 

সামরিক কায়দায় আমাকে স্যালুট দিয়ে বলল, "কিছুনা, বস...।"
- মোবাইলে কি দেখিস, শালা?
- ৩৬ তারিখে নাকি নতুন স্বাধীনতা দিবস হবে, ফেইসবুকে তাই দেখতেসি। আমি লাইক কমেন্ট শেয়ার দিয়ে পাশে আছি।

আমি আক্ষরিক অর্থেই বোকাচু হয়ে গেলাম।

- তোমার বয়স ৪৬, তুমি গেঞ্জিদের সাথে পাল্লা দিয়া আন্ডারওয়্যার পরলে কি হবে? ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে। নাদান কোথাকার।

- বস এটা নতুন বাংলাদেশ। আপনাদের দিন শেষ, এখন দেশ চালাবে তরুণরা।
- তুই তো বুইড়া ভাম, তুই কি চাস?

মাসুদ বিড়বিড় করে, "পনের বছর কই ছিলেন, ভাই?"

মাসুদের কান বরাবর একটা বন দিলাম। সে মাটিতে পড়ে উঠে আবার স্যালুট দিলো।

- পনের বছর তোর মত কুলাঙ্গাররে তিনবেলা খাওয়াইসি। 

মেজাজটা অত্যধিক খারাপ হয়ে গেলো। জীবনে কোনদিন রাজনীতি করি নাই বলে আজকে দারোয়ান শালায়ও রাজনীতি শেখায়।

গনির দোকানের দিকে রওনা দিলাম। গিয়া আরো মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। গণি দোকানে নাই। তার ছোটভাইরে বসায় রাখসে। এই ছেলে চরম বেয়াদব, দেখলে সালাম দেয়না। আদাব-কানুন কিছু শেখে নাই। গেঞ্জি জেনারেশন।

- গণি ভাই কই?

- ভাইতো পরোটার দোকান দিসে। ওই যে পাশেই। এখন থেকে আমি এখানে বসি। চা দিমু, নাকি কফি।
- কফি-ই দাও। দেখি এইটা কোন মানের শরবত!

যাক সরকার পরিবর্তনে গণির তাইলে উন্নতি হইসে। ফ্যামিলি বিজনেস বাড়সে। আমি কফি হাতে গনির পরোটার দোকানে গিয়া বসলাম। গণিরে মহা খুশি দেখাচ্ছে।

- আসসালামুয়ালাইকুম, ভাই নাস্তা করসেন?

- নাহ। একটা পরোটা দাও দেখি কেমন হয়।

- সাথে মাংস দেই। লাল মাংস কষা আছে। আপনের লাইগা হাফ দাম।

- দাও। একপ্লেট ভাতও দিতে পারো।

- ভাততো ভাই দুপুরের আগে হবে না। 

গণি বেয়ারা রাখসে, আট-নয় বছরের একটা ছেলে। সে এসে পরোটা আর মাংস দিয়ে গেলো। আমি কফিতে চুবিয়ে তেলতেলে পরোটা খাচ্ছি আর একটা একটা করে মাংসের পিস মুখে দিচ্ছি। আর দুই একজন কাষ্টমার আছে, এরা আমাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। একেতো আমার চুল কয়েকদিন কাটা হয় নাই। তারউপর একটা থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরা। আর বুকের গেঞ্জিতে লেখা, "No Woman No Cry"। দেখতে মনে হয় ডাকাতের মত লাগতেসে আমারে।

- গণি ভাই ব্যবসা তো মনে হয় ভালোই যাইতেসে?

- নারে ভাই, আগেই মনে হয় ভাল আছিলাম।

আমি মাথা নাড়লাম। গণি তার স্বভাব সুলভ চরিত্রে শুরু করতে যাচ্ছে দেশ বন্দনা।

- এখনতো সব পলাতক, দোষ কারে দিবা?

- কপালের ভাই... কপালের।

- আবার কি হইসে? দেশে তো শান্তি কায়েম হইসে এখন।

- এরকম দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?

- আফসোস করো কেন? নতুন লোক নতুন দেশ, তাগোর টাইম দেও।

"হ, ভাই...।" গণি বিড়বিড় করে কি বলল বোঝা গেলো না। আমি খাওয়া শেষ করে টাকা না দিয়েই বের হয়ে গেলাম। গণির আফসোস কিছুটা বাড়ুক।


যাচ্ছে জীবন

কক্সবাজার গিয়া সদানন্দরে বললাম "মাল খাবো"। সে জিহবায় কামড় দিয়া বললো "হারাম"। কোনভাবেই বারে নেয়া গেলো না তাকে। শেষ পর্যন্ত রুমে অর্ডার দিয়া আমি আর ভোমা ককটেল খাইলাম।

পুরাটা সময় সদানন্দ বইসা বইসা মোবাইল গুতাইলো আর আমাদের দিকে জাহান্নামী লুক দিলো।

সদানন্দরে নিয়া ঘোরার একটা ঝামেলা আছে। সে নিজে যা ভাল মনে করে সেটার উপরে আর কারো কিছু বিশ্বাস করে না। এমন এমন রেষ্টুরেন্টে নিয়া গেল খাইতে সেগুলায় আমি মুতার জন্যও যাইতাম না।

আমার সন্দেহ হইতাসে তারে মনে হয় রেষ্টুরেন্ট এর মালিক কমিশন দেয়।

দুইদিনের বেশিরভাগ সময়ই সে রুমে ঘুমাইয়া কাটাইসে, আর অল্প কিছুক্ষন তার জলহস্তীর মতন দেহ নিয়া সুইমিংপুলে ভাইসা ছিলো।

সুইমিং পুলে আবার মেলা নিয়ম কানুন, সেইখানে সুতি জামাকাপড় পইরা নামা যাবে না। শাড়ি আর বোরখা পইরা নামা যাবে না। এক ভাইজান ফুল ফ্যামিলি বোরখা নিয়া নাইমা পড়ল। ব্যাপক একটা ঝগড়া কইরাও পুলের এটেন্ডেন্ট তাদের তুলতে পারল না। ইসলামিক ড্রেস বাদে তারা পুলে নামবে না।

আমি মনে মনে কইলাম "খাইসে"। সদানন্দ একটা টি-শার্ট পরা ছিল।

- স্যার এটা পরে নামা যাবে না।
- এটা পলিস্টারের ব্রো। রঙ উঠবে না। সদানন্দ ঢাহা মিথ্যা কথা বলল।

এটেন্ডেন্ট মন খারাপ করে চলে গেল। মনে মনে গালি দিলেও মুখে কিছু বলা যাবে না।

- তুই জাহান্নামী।
- ক্যান? এইটাতো পলিস্টারই।
- তুই হাফপ্যান্ট পইরা নামসস। তোর হাঁটু দেখা যায়।

পুলের টাওয়েল নিয়া আবার রুমে যাওয়া যাবে না।

- ক্যান, আমি কি ন্যাংটা যামু, নাকি এই ভিজা কাপড়েই যামু?
- না স্যার, এখানে শাওয়ার আছে। শাওয়ার নিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে যাবেন।
- বালের নিয়ম বানাইসো? দেশের এই দূর্দিনে আমরা পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে টাকা খরচ করতেসি এইগুলা দেখার জন্য?

- স্যার, আমাদের এইখানে এরকমই নিয়ম। এটেন্ডেন্ট আমারে বলল।
- এক কাম করেন হোটেলে ঢুকলে একটা ইউনিফর্ম দিয়া দেন। আমরা লেফট-রাইট করতে করতে ক্লাস করি।

এটেন্ডেন্ট তার মেকি হাসি দিয়ে চলে গেলো।

আসার সময় সদানন্দ বস্তা ভইরা শুটকি কিনসে। তারে একবার বলসিলাম, শুটকি খাইস না এগুলায় ক্যামিক্যাল আছে। তোর লিভার, কিডনি দুচে দেবে। সদানন্দ জানাইসে, এইগুলা গিফট করে দেবো। মরলে আরেকজন মরুক। সে ভেজিটেরিয়ান।

এইরকম ইউনিক ক্যারেকটার হইলেও একটা দিক দিয়া সে ভালো, সে কখনো বন্ধুবান্ধবের খারাপ চায় না। আজ পর্যন্ত যতবার তারে বিপদে আপদে ডাক দিসি বুক পাইতা আইসা খাড়াইয়া গেসে। নিজের থেকে বুদ্ধি দেয়ার চেষ্টা করসে।

তার খারাপ দিক হইল, সে নিজেরে সবার মত বড়লোক মনে করে, আমি দিন আনি দিন খাই টাইপের মানুষ। কিন্তু তার ধারনা আমি ম্যাল্যা টাকাটুকা কামাই।

চিন্তা করসি আগামী তিন মাস তার সাথে যোগাযোগ করব না। দেখা হইলেই পয়সা লস।

শামীম ভাই সমাচার

শামীম ভাইরে দেখলেই আমি টুপ করে কোন একটা গলিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করি। বয়সে আমি তার হাঁটুর সমান। তার বয়স ৬০ এর উপরে। কিন্তু প্রতিদিন সকালে তিনি জগিং করতে বের হন। সাদা একটা ট্রাউজার আর ঘিয়া কালারের টি-শার্ট পরে।

এই বয়েসের লোকজনরে সাধারণত আমার চাচা বলে ডাকার কথা। কিন্তু আমি যেহেতু ঘাউরা কিসিমের, আমি কাউরে স্যার বা আংকেল বইলা ডাকি না। আমার কাছে সবাই ভাই। যত মুরুব্বিই হোক আমি ভাই ডাকি। অতীতে দেখেছি, কাউরে চাচা ডাকা মাত্র সে আমারে দেখা হইলে এমনভাবে ভাইস্তা বলে ডাক দেয় যেন আমি মাত্র দুধ খাইয়া উঠছি।

আর সবচেয়ে বড় কথা, মুসলিম-মুসলিম ভাই ভাই। আমি এই নীতি মাইনা চলি।

শামীম ভাইয়ের কথা বলতেসিলাম। একদিন গনির দোকানে দাঁড়ায়া চা-ব্রি সেবন করতেসিলাম। শামিম ভাই আইসা বললেন- "তোমারে চেনা চেনা লাগে।" এইটা হইল কথা জমানোর ধান্দা। বিড়ি খাবার সময় আমি সাধারণত কাউরে চিনি না। অতীতে চিনতে দিয়া পস্তাইসি। এক মালব্রোর দাম ১৮ টাকা এখন আর চা ১০ টাকা। কাউরে চিনা ফেললেই ২৮ টাকা লস।

- হইতে পারে, এলাকায় জন্মের পর থেকে আছি।

শামীম ভাই আমার কথায় মাইন্ড করলেন না। তিনি আইছেন গল্প জমাইতে।

- বাচ্চারে স্কুলে দিয়া আসলা?
- আসলাম, আপনেও কি বাচ্চারে স্কুলে দিসেন? আপনার বাচ্চা কোন স্কুলে পড়ে?
- বাচ্চা না, আমার নাতনীরে দিয়া আসি মাঝে মধ্যে।
- ও... আমি কিছুটা বুকাচু হইয়া গেলাম। কি বলব খুঁজে পাই না।

এরপর ম্যালাদিন তার সাথে চা-ব্রি সেবন কালে দেখা হইসে। তিনি আমারে একদিন জোর কইরা তার বাসায় নিয়া গেলেন। চা কম খাই বলার পরেও, তার বাসায় বইসা চা আর ব্রি খাওয়াইলেন। নিজের বাড়িঘর দেখাইলেন। এই পর্যন্ত সমস্যা ছিলো না। 

কিন্তু তিনি আমারে বিকালে বা সন্ধ্যায় দেখা করতে বলেন। আড্ডা দেয়ার জন্য। বয়স চল্লিশ হবার পরে আমি সাধারণত আড্ডা কম দেই। আমার চেহারায় বালকসুলভ একটা বিষয় আছে। দেখতে ইনসেন্ট লাগে। এই রকম একটা বুইড়ার সাথে আড্ডা দিলে আমার চলে?

তারওপর তিনি সর্বদা আমার পরিবারের কথা জিগ্যেস করেন, কে কোথায় আছেন, কেমনে আছেন, আমি কি করি ইত্যাদি। আমি কত ইনকাম করি - তার এই প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি ক্লান্ত।

তিনি দেশ স্বাধীন হবার আগে, মোবাইলে এলাকার কোন এম্পির লগে তার ছবি আছে, কোন কমিশনারের লগে তার অবৈধ রিলেশন সেগুলা আমারে দেখাইসিলেন। দেশ স্বাধীনের পরে আর দেখান নাই। এই বিষয়ে আমি মাইন্ড খাইসি।

মেলা দিন পর তার সাথে আবার দেখা হইসিলো সেদিন। ফার্মেসির সামনে টুলে বইসা আছেন। জগিং ড্রেস, সেই গোল্ড ফ্রেমের চশমা।

জিগাইলাম "কেমন আছেন?"

- তুমার তো মিয়া কোন খবর নাই।

- আছিলাম একটু দৌড়ের উপর। আমি বিস্তারিত বলতে চাই না। এমন রিমঝিম বৃষ্টির সকালে তার সাথে দেখা হওয়া মানেই এক ঘন্টা নষ্ট।

- বইসা আছেন কেন? আজকে জগিং করবেন না?
- নাহ পায়ে ব্যাথা পাইসি। অটো রিকশা থেকে পইড়া গেসিলাম।
- হ... শালারা মা..দা.। আমি পুরা বাক্য শেষ করলাম না। তিনি জান্নাত হোটেলে আমারে চা খাওয়াইতে নিয়া গেলেন। আমি চায়ের বিল দিয়া দিলাম। মাগনা খাইতে ভালো লাগে না।

আমি আসলে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি দেইখা আসছিলাম চিকেন খিচুড়ি কিনতে। আড্ডা আরোও জমতে পারত কিন্তু আমার খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ক্লায়েন্টের সাথে জরুরী মিটিং আছে বইলাল আমি পার হয়া গেলাম।

যাবার সময় তিনি তার সেই সদা হাসসোজ্জ্যল ভঙ্গিতে জিগ্যেস করলেন, আমারে ইয়াং লাগতেসে না?

কি আর কমু! কইলাম, আপনে এমনেই দেখতে সুন্দর। একটা রিচার্ড গিয়ার টাইপ লুক আছে। ইয়াং হইয়া কি করবেন?

মানুষ নিয়ে গবেষণা করা এই আমি এখনো তারে ঠিক ধইরা উঠতে পারি নাই। তিনি মানসিক ভাবে সুস্থ, কিন্তু নিঃসঙ্গ একজন মানুষ এইটা বুঝতে পেরে আমার মাঝে মাঝে মায়া হয়। তার থেকে আমি পালিয়ে বেড়াই কারন তিনি বেশি কথা বলেন আর নিজের সম্পর্কে আমি বেশি কথা বলা পছন্দ করি না। আমার কোন এক গল্পে তারে টুক কইরা ঢুকাইয়া দিব।